Skip to main content

•••প্রিন্সেপ ঘাট•••

সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতা।এই শহর কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে কত ইতিহাস, কত স্থাপত্য, কত ঐতিহ্য।এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আজ পুরোনো কলকাতার স্মৃতিকে বহন করে চলেছে। গঙ্গার বুকে গড়ে ওঠা প্রিন্সেপ ঘাট তেমনই এক ঐতিহাসিক নিদর্শন।

আজ আমরা জেনে নেব প্রিন্সেপ ঘাট সম্পর্কে।

প্রিন্সেপ ঘাট হল কলকাতায় হুগলি নদীর তীরে ব্রিটিশ যুগে নির্মিত একটি ঘাট।প্রিন্সেপ ঘাটটি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ওয়াটার গেট ও সেন্ট জর্জ গেটের মাঝে অবস্থিত। এটি তদকালীন ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড এডেনবরার নির্দেশে ১৮৪১ সালে নির্মিত হয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ইতিহাসবিদ জেমস প্রিন্সেপের নামে নামাঙ্কিত।ব্রিটিশ যুগে তৈরী প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ঘাটটি কলকাতায় হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত। ঘাটের পাশেই স্মৃতিসৌধ তৈরী রয়েছে।


বিশাল জায়গা নিয়ে স্মৃতিসৌধটি তৈরী করা হয়েছে। সৌধটির সামনে বেশ বড় খালি জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা রয়েছে। এই জায়গাটিতে একটি মা ও বাচ্চা হাতির মূর্তি করে রাখা আছে।জেমস প্রিন্সেপের সমাধিসৌধ বা স্মৃতিসৌধটি একটি অসাধারন স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে সৌন্দর্যের এক অপরূপ সংমিশ্রণ। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন। সৌধটির গা ঘেসেই গড়ে উঠেছে ঝুলন্ত বিদ্যাসাগর সেতু বা দ্বিতীয় হুগলী সেতু। এখান থেকে একটু এগেলেই একটা রেল লাইন পড়ে। এই লাইনটিতে চক্ররেল চলাচল করে। এখানে চক্ররেলের স্টেশনটির নামও "প্রিন্সেপ ঘাট"।


কি মনে প্রশ্ন জাগছে না যে কে এই জেমস প্রিন্সেপ?কেনই বা তাঁর নামে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হল? 


এবার আমরা জানবো কে এই জেমস প্রিন্সেপ।


১৮১৯ সালে ১৫ ই সেপ্টেম্বর মাত্র ২০ বছর বয়সে ইংল্যান্ড থেকে চাঁদপাল ঘাটে এসে নেমেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ নামে এক যুবক। তিনি কলকাতার টাঁকশালে সহকারী ধাতু পরীক্ষক(Assey Master) হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁর এই শহরে পদার্পন।

জেমস প্রিন্সেপের জন্ম ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে আগস্ট ইংল্যান্ডে। পিতা জন প্রিন্সেপ (১৭৪৬ - ১৮৩০) ও মাতা সোফিয়া এলিজাবেথ অরিয়ানের (১৭৬০ - ১৮৫০) দশটি সন্তানের মধ্যে সপ্তম সন্তান জেমস প্রিন্সেপ ছিলেন সবচেয়ে কীর্তিমান। কপর্দকহীন অবস্থায় ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে জন প্রিন্সেপ ভারতে আসেন এবং অন্যতম নীলকর হিসাবে বিশেষ প্রতিষ্ঠা পান। চল্লিশ হাজার পাউন্ডের ধনসম্পত্তি অধিকারী ইস্ট ইন্ডিয়ান বণিক হয়ে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ফিরে যান।

 জেমস প্রিন্সেপের প্রাথমিক পড়াশোনা মি. বুলক পরিচালিত ক্লিফটনের এক স্কুলে শুরু হয় এর পর জেমস নিজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন। তবে জেমস ড্রয়িং ও বিভিন্ন যান্ত্রিক আবিষ্কারের প্রতি মেধার কারণে অগাস্ট পুগিন কাছে স্থাপত্যবিদ্যায় শিক্ষা নেন। কিন্তু যখন তার পিতা জানতে পারলেন ভারতের টাঁকশালে ধাতুপরীক্ষণের জন্য বিভাগ চালু হবে, তিনি জেমসকে রসায়নবিদ্যায় শিক্ষা দিয়ে লন্ডনের রয়াল টাঁকশালের ধাতু পরীক্ষক রবার্ট বিংলে'র সহকারী হিসাবে দুই বৎসরের (১৮১৮ -১৮১৯) প্রশিক্ষণ নিতে পাঠান।


কলকাতার টাঁকশালের তার ঊর্ধতন ধাতু-পরীক্ষক বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ হোরেস হ্যামেন উইলসনের নির্দেশে জেমস বারাণসী টাঁকশালে যান। সেখানে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে টাঁকশাল বন্ধ হওয়া পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি আবার কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে উইলসন পদত্যাগ করলে (সেই পদে উইলসনের মনোনীত প্রার্থী, জেমস অ্যাটকিনসনের স্থানে) জেমস ধাতু পরীক্ষক হন।


তিনি ধাতু পরীক্ষক হিসাবে কাজ করার সময় বহু বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা করেছেন। তিনি চুল্লীগুলির তাপমাত্রা সঠিকভাবে পরিমাপ করার উপায় বের করেছিলেন। এর কৌশল সম্পর্কে তার লেখা ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের 'ফিলোজফিক্যাল ট্রানজাকশন অব দ্য রয়াল সোসাইটি'তে প্রকাশের পর তিনি রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি প্ল্যাটিনামের তাপীয় প্রসারণের পাশাপাশি মাইকা প্লেটগুলির ক্রমাঙ্কিত সিরিজ ব্যবহার করে ভিজ্যুয়াল পাইরোমিট্রিক পরিমাপের সম্ভাবনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য প্লাটিনাম, স্বর্ণ ও রৌপ্য মিশ্রণের মিশ্রণগুলিকে একটি কাপ বা ক্রূশিবলের মধ্যে রেখে তাদের গলন পর্যবেক্ষণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি এমন একটি পাইরোমিটারও উদ্ভাবনা করেছিলেন যা স্বর্ণের বাল্বের মধ্যে রাখা স্বল্প পরিমাণ বায়ুর প্রসারণ পরিমাপ করে। ১৮৩৩ সালে তিনি ভারতীয় ওজন ও পরিমাপের সংস্কারের প্রস্তাব রেখেছিলেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন রুপোর টাকার উপর ভিত্তি করে একটি অভিন্ন মুদ্রা জারির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তিনি এক সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল ওজন পরিমাপক যন্ত্র তৈরি করেছিলেন।


এ তো গেল জেমস প্রিন্সেপের পরিচয়, এবার অবশ্যই মনে প্রশ্ন জাগছে যে কেন জেমস প্রিন্সেপ এতো বিখ্যাত এবং তাঁর জন্য কেনই বা স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে?


জেমস প্রিন্সেপের বিখ্যাত হওয়ার পিছনে রয়েছে এত কম বয়সে তাঁর অনবদ্য কৃতিত্ব। একটি মানুষ যে এতো রকম বিষয়ে পারদর্শী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুবই বিরল। তিনি,ভারতে স্হাপত্যশিল্প, ভাষাতত্ত্ব, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল,মুদ্রাশাস্ত্র, মানচিত্র অঙ্কন প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এবার একে একে সব বিষয়ে বিশদে জানবো


-:স্থাপত্যশিল্প:-

জেমস প্রিন্সেপের স্থাপত্য বিষয়ে প্রচুর আগ্রহ ছিল এবং বারাণসীতে বহু নিদর্শন রেখেছেন। বারাণসীতে নতুন পুদিনা ভবনের পাশাপাশি সেন্ট মেরি গির্জার স্থপতি তিনি। তিনি বেনারসের বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ ছাড়াও তিনি আওরঙ্গজেবের মসজিদে্র উদ্ধারকর্তা ছিলেন। কলকাতা থেকে জলপথে বারাণসী যাওয়ার সময় তিনি গঙ্গার দু-পারের যে ছবি আঁকতে আঁকতে যান তা নিয়ে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বই প্রকাশ করেছেন - 'ভিউজ অ্যান্ড ইলাস্ট্রেশন অফ বেনারস'। বারাণসীর উৎসবগুলির জলরঙের একটি চিত্রও এঁকেছিলেন। সেটি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং ১৮৩০ থেকে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেনারস ইলাস্ট্রেটেড নামে একটি সিরিজের অঙ্কন প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বারাণসীর ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলির স্যানিটেশন উন্নত করার জন্য নিশ্চল হ্রদগুলি নিষ্কাশন করতে এবং একটি খিলানযুক্ত সুড়ঙ্গপথ ডিজাইন করতে সহায়তা করেছিলেন এবং কর্মনাশা নদীর উপর একটি পাথরের সেতু নির্মাণ করেছিলেন। তিনি যখন কলকাতায় চলে আসেন, তার ভাই বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সদের ক্যাপ্তেন টমাস প্রিন্সেপ হুগলি নদীকে সুন্দরবনের সাথে যুক্ত করতে একটি খাল কাটতে শুরু করেন, কিন্তু ভাইয়ের আকস্মিক প্রয়াণে জেমস প্রিন্সেপ সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন।


-:মুদ্রাশাস্ত্র:-

মুদ্রা সম্পর্কে জেমস প্রিন্সেপের আগ্রহ ছল সর্বাধিক। তিনি গুপ্ত আমলের "পাঞ্চ চিহ্নিত" বা ছপাঙ্কিত মুদ্রাসহ ভারতীয় প্রচলিত মুদ্রার পাশাপাশি বাক্টরিয়া এবং কুশাণ আমলের মুদ্রার পাঠোদ্ধার ও বিশ্লেষণ করেন। প্রিন্সেপ মুদ্রা প্রচলনের পর্যায়ে ছাপাঙ্কিত, নকশা খচিত ও ছাঁচে ঢালাইকৃত তিনটি স্তরের মুদ্রা জারির প্রস্তাব রাখেন। প্রিন্সেপ দেশীয় পাঞ্চ চিহ্নিত মুদ্রা সম্পর্কেও জানিয়েছিলেন, উল্লেখ করে যে তারা পূর্ব ভারতে বেশি পরিচিত ছিল।


-:এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল:-

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন জেমস ডি হারবার্ট নামের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী "গ্লানিংস ইন সায়েন্স" নামের এক ধারাবাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেছিলেন। ক্যাপ্টেন হারবার্ট ১৮৩০ খ্রিষ্টাবদে অবধের রাজার দরবারে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে যোগ দেন তখন জার্নালটির জেমস প্রিন্সেসের সম্পাদনায় ছিল এবং জেমস নিজে এর প্রধান লেখক ছিলেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর সেক্রেটারি হিসাবেহোরেস হ্যামেন উইলসনের স্থলাভিষিক্ত হলে প্রিন্সেপ এই জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হয়ে ওঠেন এবং রসায়ন, খনিজ বিজ্ঞান, সংখ্যাতত্ত্ব এবং ভারতীয় পুরাতত্ত্বের উপর বহু নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি আবহাওয়া নিরীক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণের সারণী তৈরি এবং সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত আবহাওয়া তথ্যের বিশ্লেষণে খুব আগ্রহী ছিলেন। আর্দ্রতা এবং বায়ুমণ্ডলের চাপ পরিমাপ করতে তিনি ব্যারোমিটার নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থ হওয়া পর্যন্ত তিনি জার্নালটির সম্পাদনা করেন। পরে ভারত ত্যাগ করে ইংল্যান্ড ফিরে যান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়। তথ্য সম্বন্ধীয় বহু চিত্রসহ বিবরণ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।


-:ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার:-


এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের সম্পাদক হিসাবে প্রিন্সেপের কাজের পরিপেক্ষিতে, সারা ভারত থেকে তার কাছে মুদ্রা এবং শিলালিপিগুলির অনুলিপি পাঠানো হত সেগুলির পাঠ উদ্ধার করে, অনুবাদের শেষে প্রকাশ করার জন্য।


ব্রাহ্মী লিপি র পাঠোদ্ধারের প্রথম সফল প্রচেষ্টা ১৮৩৬ সালে নরওয়ের পণ্ডিত খ্রিস্টান লাসসেন করেছিলেন , তিনি ইন্দো-গ্রীক রাজা আগাথোক্লেস এবং প্যান্টালিয়নের দ্বিভাষিক গ্রীক-ব্রাহ্মী মুদ্রাকে বেশ কয়েকটি ব্রাহ্মী বর্ণকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বহু রহস্য উন্মোচন ছিল জেমস প্রিন্সেপের এক দশকের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব


জেমস প্রিন্সেপ হোরেস হ্যামেন উইলসনের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হন ভারতবিদ্যাচর্চায়। তার বড়ো অবদান অশোক লিপির পাঠোদ্ধার। ১৮৩৬–-৩৮-এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান হতে পাওয়া শিলালিপি অন্তর্ভুক্ত। এই লিপিগুলি মূখ্যত দিল্লি এবং এলাহাবাদ স্তম্ভগুলিতে এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমের মুদ্রা এবং শিলালিপিতে খরোষ্ঠী লিপিতে পাওয়া যায়। গুজরাটে পাওয়া যে গিরনার অশোক লিপির তিনি পাঠোদ্ধার করেন, সেটিতে ছিল গ্রিক রাজা অ্যান্টিওকাস আর ইজিপ্টের টলেমির উল্লেখ। অশোকের আমলে ভারতবর্ষের মানবিক ভূগোল যে কত বিস্তৃত ছিল এ লিপিই তার প্রমাণ। ভারতীয় লিপিগ্রন্থের সংকলন - "করপাস ইনসিলিঙ্কাম ইন্ডিকারামের " ধারণাটি জেমস প্রিন্সেপের। পরে ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজ শুরু করেছিলেন। প্রিন্সেস্পের গবেষণা এবং রচনা কেবল ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রিন্সেপ আফগানিস্তানের প্রারম্ভিক ইতিহাসেরও অনুসন্ধান করেছিলেন এবং সেগুলির বেশ কয়েকটি রচনা সে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সঠিক খোঁজ দিয়েছিল। সেগুলির বহু সংগ্রহ আলেকজান্ডার বার্নেস হতে প্রাপ্ত। জেমস প্রিন্সেস্পের মৃত্যুর পরে, তার ভাই হেনরি থোবি প্রিন্সেপ ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তান থেকে তৈরি সংকলন সম্পর্কিত সংখ্যাতাত্ত্বিকের কাজ অনুসন্ধান করে একটি খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন।


তাঁর কর্মজীবন ভারতে হলেও তিনি তখন ইংল্যান্ড ফিরে যান তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়।জেমস প্রিন্সেপ মাত্র ৪১ বৎসর বয়সে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে এপ্রিল ইংল্যান্ডে প্রয়াত হন। 


একজন প্রতিভাবান শিল্পী ও ড্রাফটসম্যান হিসাবে জেমস, প্রিন্সেপ বহু প্রাচীন স্মৃতিসৌধ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, যন্ত্র, জীবাশ্ম এবং অন্যান্য বিষয়ের সূক্ষ্ম স্কেচ তৈরি করেছিলেন। তিনি আবহাওয়া সম্প্রকে সঠিক ধারণার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি একটি ব্যারোমিটার ডিজাইন করেছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যারোমিটার সরবরাহ করা এবং অন্যের ছকের সাথে তৈরি করা বিবরণ ছাড়াও আবহাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ের বিবরণী রাখতেন।


কি এবার বুঝলেন তো কেন জেমস প্রিন্সেপ ইংল্যান্ডের মানুষ হয়েও ভারতের ইতিহাসে এত বিখ্যাত।


কি মন চাইছে নাকি স্মৃতি সৌধ টি দেখতে যেতে....তবে অবশ্যই বলবো সুযোগ পেলে গিয়ে ঘুরে আসুন আপনার মনের মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে.........এ মা লজ্জা পাচ্ছেন?

 তাহলে শুনুন,

জেমস প্রিন্সেপ "সোফিয়া অবার্টকে" ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে এপ্রিল কলকাতার "ক্যাথেড্রাল চার্চে" বিবাহ করেন। পরে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের এক কন্যা "এলিজা" জন্ম গ্রহণ করে।তাঁদের একে অপরকে বিবাহের কথা প্রথম বলেন এই গঙ্গা তীরেই তাঁরা প্রায়ই আসতেন বিকালের দিকে সান্ধ্যসুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করতে। তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত এই এলাকা এখন প্রিন্সেপ ঘাট ও তার সংলগ্ন এলাকা।বর্তমানে এই এলাকা অতিমনোরম এবং সাজানো গোছানো। বলিউডে নির্মিত পরিণীতা ছবির একটি গানের শ্যুটিং প্রিন্সেপ ঘাটে হয়েছে।জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন।সৌধটির গা ঘেষেই গড়ে উঠেছে ঝুলন্ত বিদ্যাসাগর সেতু বা দ্বিতীয় হুগলী সেতু। ১৯৯২ সালের ১০ই অক্টোবর এই সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই সেতুর তারগুলি স্মৃতি সৌধটিকে যেন একটা নতুন রূপ দিয়েছে। ব্রিটিশ স্থাপত্যের সাথে ভারতীয় স্থাপত্য মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এখানে। এখান থেকে একটু এগেলেই একটা রেল লাইন পড়ে। এই লাইনটিতে চক্ররেল চলাচল করে।

পাশেই চক্র রেলের একটা স্টেশন আছে। স্টেশনটির নামও "প্রিন্সেপ ঘাট"। স্টেশনটি বেশ সুন্দর ও নিরিবিলি, খুবই পরিষ্কার। চক্ররেলটি। সম্ভবত ১৯৮৪ সাল নাগাদ চালু করা হয়েছিল। ট্রেন লাইনটি পার হলেই হুগলী নদীটি দেখা যায়। এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল লর্ড এডেনবরার তৈরী জেমস প্রিন্সেপের নামাঙ্কিত সেই ঘাটটি। ঘাটে অনেকগুলো নৌকো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই নৌকোগুলো করেই মনোরম নৌবিহার করার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘাটটির সামনে বসার জন্য কয়েকটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। খুব হালকা আওয়াজে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে। নদীকে সামনে রেখে এই বেঞ্চে বসে রবীন্দ্র সংগীত শোনার অভিজ্ঞতা সারা জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত গড়ে তোলে। নদীতে নামার ঘাটটি খুব সুন্দর করে বাঁধানো আছে। আগের তুলনায় এখনকার প্রিন্সেপ ঘাটটিতে অনেক বদল ঘটে গেছে। এখানে সবুজায়ন ও সৌন্দর্য্যায়ন যেন হাতে হাত রেখেছে। নদীর ধারে কংক্রিটের রেলিং ও বাধাঁনো সুন্দর রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে নদী তীরের সুন্দর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটা খাবারের স্টল আছে। এই স্টলগুলোতে বসে একটু খাবারের স্বাদ নিতেও মন্দ লাগে না।


২০১২ সালের ২৪ মে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাজে কদমতলা ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথে সৌন্দর্যায়িত নদীতীরের উদ্বোধন করা হয়েছে।এই অংশটি আলোকমালা, বাগান, প্রমোদপথ, ফোয়ারা দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং এই অংশের ঘাটগুলির সংস্কার করা হয়েছে।

ঘাটের নিকটবর্তী ম্যান-অ-ওয়ার জেটিটি কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কলকাতা বন্দরের গৃহীত ভূমিকার স্মৃতি বহন করছে। জেটিটি এখন মূলত ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যবহার করে। এটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।


সন্ধ্যার মুখে যখন সূর্যটা সোনালী থালা হয়ে পশ্চিমপাড়ে হেলতে শুরু করে, তখন নদীর বুকে একটা মোহময়ী রূপ তৈরী হতে দেখা যায়। প্রিন্সেপ ঘাটের বেঞ্চে বসে এই মোহময়ী রূপ দেখা বেশ রোমাঞ্চকর। সন্ধ্যার পর আলোকিত সৌধটিকেও দেখতে ভারী সুন্দর ও মায়াবী লাগে।


এই ব্যাস্ত শহরের মাঝে এতো মনোরম ,সৌন্দর্যময় জায়গায় একবার গেলে সব ক্লান্তি দূর হতে বাধ্য। নয়নাভিরাম দৃশ্যের সাথে এক ঝলক নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে চাইলে অবশ্যই চলে আসুন প্রিন্সেপ ঘাটে আর দেখে আসুন জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতিসৌধ।


লেখাঃ গৌরব মিশ্র

তথ্যঃ-ইন্টারনেট

ইতিহাসে বাংলার ফেসবুক পেজ

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

"বীরভূমের হাজারদুয়ারী": হেতমপুর

 আজ সকলকে শোনাবো বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের নিকট " হেতমপুর "নামক একটি জনপদের গল্প। এখানে আজও বর্তমান ৯৯৯ টি দরজা বিশিষ্ট রাজ অট্টালিকা। যা " বীরভূমের হাজার দুয়ারী " নামেও পরিচিত।এই হেতমপুরের পূর্ব নাম ছিল রাঘবপুর, এই নামের পরিবর্তনের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। রাজনগরের জমিদার রাঘব রায়ের নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানটির। রাজনগর রাজাদের অনুরোধে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান এসেছিলেন, বিদ্রোহী রাঘব রায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাঘব রায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে, হাতেম খান এই জায়গার জমিদার হয়ে ওঠেন এবং এর নামকরণ করা হয় হাতেমপুর। সময়ের সাথে সাথে এটি হয়ে উঠেছে হেতমপুর। যদিও এ ঘটনা বঙ্গে নতুন নয়।  এবার জানবো সেই রাজপরিবার ও তার ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজবাড়ি সম্পর্কে।  হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যুর পর বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান...

মমতাময়ী রাণীমা:শক্তিস্বরূপিনী রাণী রাসমণি।

 " নারী " সৃষ্টির আধার,"নারী"-ই শক্তি, "নারী"-ই পরমাপ্রকৃতি।আবার এই নারী যখন একাধারে হয় দেশপ্রেমিক,আধ্যাত্মিক মনভাবাপন্না,সেই সঙ্গে হয় মমতাময়ী ও ঈশ্বরের আর্শীবাদ ধন‍্যা,তখন সেই নারী হয়ে ওঠে অনন্যা। আমার উৎসাহী পাঠকবর্গকে আজ এমনই এক বিরল প্রকৃতির নারীর জীবনবৃত্তান্ত শোনাবো।যাঁর মনে ছিল গভীর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের জন্য ছিল পরম মমতা এবং চোখে ছিল অদম্য সাহস। পরমাত্মার অশেষ কৃপায় ও তাঁর নিজ গুণে তিনি হয়ে উঠেছেন লোকমাতা রাণী রাসমণি। মহিয়সী এই নারী একদিকে যেমন ছিলেন একজন সমাজ সেবিকা,ঠিক তেমনই অন‍্যদিকে  তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণা,ঈশ্বরপ্রেমী মানুষ। রাণী রাসমণি ইতিহাসে বাংলা ফেসবুক পেজ ১৭৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের 'কোনা' গ্রামে এক দরিদ্র কৃষিজীবী  স্বর্গীয় হরেকৃষ্ণ দাশ ও স্বর্গীয়া রামপ্রিয়া দাশির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।রামপ্রিয়া দেবী ভালোবেসে কন‍্যার নাম " রাণী ",কিন্তু পরে প্রতিবেশীদের দৌলতে তা হয়ে ওঠে " রাণী রাসমণি "। রাসমণি মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার জানবাজারের জমিদার বাবু প্রিতরাম দাসের সুযোগ্য প...

•••ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যা•••

পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লক এর ক্ষীরগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা যোগাদ্যা।বাংলার অন্যতম একটি সতীপীঠ হলো এই ক্ষীরগ্রাম। এখানে দেবী সতীর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি পতিত হয়েছে। দেবী রূপে মহিষাসুরমর্দিনী। দেবী মূর্তি কষ্টি পাথরের তৈরী। এখানে দেবী পাতালবাসীনি।মা যোগাদ্যার মূর্তিটি সারাবছর ক্ষীরদিঘির জলে নিমজ্জিত থাকে। বৈশাখী সংক্রান্তি সময় মায়ের আবির্ভাব দিবস বা বিশেষ পুজোর সময় মাকে জল থেকে তুলে এনে চলে পূজো। প্রাচীন দেবী মূর্তি ক্ষীরগ্রামের পূজিত প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনো কারনে হারিয়ে গেছিল। মোটামুটি ২০০ বছর আগে, বর্ধমান মহারাজ কীর্তিচন্দ্র নির্দেশে দাঁইহাটের নবীন ভাস্কর নতুন যোগাদ্যা মূর্তিটি তৈরি করেন। এই নবীন ভাস্করই হলেন তিনি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দিরের মা ভবতারিণীর মূর্তি নির্মাণ করেছেন। পরবর্তীকালে ক্ষীরদিঘী সংস্কারের সময় পুরনো মূর্তিটি পাওয়া যায়। বর্তমানে পুরনো মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি এবং নবীন ভাস্কর এর তৈরি নবীন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, দুটি ভিন্ন মন্দিরে পূজিত হয়। মায়ের মন্দিরটিও বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচন্দ্রর নির্দেশে নির্মান করা হয়। মন্দিরের তোরণটিও বেশ নজরক...