সুভাষ চন্দ্র বসু তখন শুধুই জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ বোস,তখনও তিনি নেতাজী হননি।১৯৩৯-এ কংগ্রেসের মধ্যে থেকে সুভাষ বোস ঘোষণা করেন যে, ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি দল গঠন করবেন। নতুন দল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল মতাদর্শের অনুসারী সংস্কারপন্থীদের সর্বজনগ্রাহ্য ঐকমত্যের বৃহত্তম পদক্ষেপের প্রতিফলনসহ দেশের সকল সংস্কারপন্থি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল শক্তিকে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সকল সংস্কারপন্থী, অর্থাৎ সমাজবাদী, সাম্যবাদী এবং কিষাণসভাপন্থিগণ তাঁর আহবানে সাড়া দেবেন।১৯৩৯ সালে ৩রা মে "ফরওয়ার্ড ব্লক" সুভাষচন্দ্র বসুর হাত ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়।
সুভাষ বসু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ডানপন্থী শক্তির আপোষ নীতির বিরোধী ছিলেন। এ ডানপন্থী শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করতে ইচ্ছুক ছিল না। যুদ্ধের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে তিনি সুপারিশ করেন যে, ব্রিটেনকে ছয় মাসের একটি চরমপত্র প্রদান করে কংগ্রেসের উচিৎ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা। যাহোক, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাঁর সুপারিশ ও হুঁশিয়ারিকে প্রত্যাখ্যান করে।
![]() |
ফরওয়ার্ড ব্লকের তৎকালীন দলীয় পতাকা |
১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে মুম্বাইতে সর্বভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লক-এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন একটি বাম পন্থী কমিটি গঠনের অনুমোদন প্রদান করে। ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক-এর কমিটি ঘোষণা করেন। এ কমিটির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সুভাষ বসু, সভাপতি; সার্দুল সিং কাভিশার (পাঞ্জাব), সহ-সভাপতি; লালশংকর লাল (দিল্লি), সাধারণ সম্পাদক; পন্ডিত বি. ত্রিপাঠী এবং কে. এফ নরিম্যান (মুম্বাই), সম্পাদকদ্বয়। অন্যান্য প্রখ্যাত সদস্যগণ হলেন অন্নপূর্ণিয়া (অন্ধ্রপ্রদেশ), এবং সেনাপতি বপত এবং এইচ.ভি কামনাথ (মুম্বাই)। সুভাস বসুর একজন বিশ্বস্ত অনুচর সত্যরঞ্জন বক্সী বঙ্গীয় প্রাদেশিক ফরওয়ার্ড ব্লকের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৩৯-এর আগস্টের প্রথমদিকে ফরওয়ার্ড ব্লক একই নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। সুভাস বসু নিয়মিত এর সম্পাদকীয় লিখতেন। তিনি সারা ভারত ভ্রমণ করেন এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইয়ের পক্ষে যোগদানের জন্য জনগণের, বিশেষ করে যুবকদের প্রতি আহবান জানান। বাম ঘেঁষা কতিপয় কংগ্রেস নেতা সুভাষের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে বিশেষ সমালোচনা মুখর ছিলেন। জওহরলাল নেহরু ফরওয়ার্ড ব্লককে অশুভ বলে চিহ্নিত করেন। জে.পি নারায়ণ কংগ্রেসের মধ্যে উপদল গঠনের বিরোধী ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাধারণ যুদ্ধে সমাজবাদীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য এস. সত্যমূর্তি মন্তব্য করেন যে, ফরওয়ার্ড ব্লক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে সাহায্য করছিল না। বরং দলটি কংগ্রেস ও ভারতের শত্রুদের সাহায্য করছিল। যাহোক, উপরিউক্ত নেতৃবৃন্দের বক্তব্য কোনভাবেই নিজস্ব কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে তাঁর প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করতে পারে নি। যুদ্ধের দ্বারা সৃষ্ট সংকটের সময় ব্রিটিশদেরক চাপ দেওয়ার প্রশ্নে তিনি অবশ্য তাঁর বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে, তিনিই ছিলেন সঠিক এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা ছিলেন ভুল পথে। কংগ্রেসের তোষণ নীতির সমালোচনার মাধ্যমে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
![]() |
বর্তমান ফরওয়ার্ড ব্লকের দলীয় পতাকা |
১৯৪০ সালের মার্চ মাসে সুভাষ বসু বিহারের রামগড়ে এক ‘আপোষ বিরোধী সম্মেলন’ এর আয়োজন করেন। ফরওয়ার্ড ব্লক এবং কিষাণ সভার যৌথ উদ্যোগে এ সম্মেলনের আহবান করা হয়েছিল। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকারকে সৈন্য, অর্থ বা দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা না করার জন্য জনগণকে আহবান জানিয়ে ১৯৪০-এর এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী এক সংগ্রামের সূচনা করা উচিৎ। সম্মেলনে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ভারতীয় সম্পদের শোষণকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। ভারতীয় জনগণ ফরওয়ার্ড ব্লক কর্তৃক সূচিত দেশ্যাপী এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুল সংখ্যায় অংশ গ্রহণ করে।
১৯৪০ সালের জুন মাসে নাগপুরে সর্বভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লকের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে রামগড়ের আপোষ বিরোধী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ফরওয়ার্ড ব্লক অনতিবিলম্বে ভারতে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠনের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে। কলকাতায় তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে অন্তরীণ অবস্থা থেকে সুভাষ বসুর মহানিস্ক্রমণ ঘটনার পর ১৯৪১ সালে ভারত সরকার ফরওয়ার্ড ব্লকের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে। দলের নেতা ও কর্মিগণ এম.কে গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে এবং তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণ করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের প্রায় সকলকেই কারাগারে রাখা হয়। যুদ্ধের শেষে ফরওয়ার্ড ব্লকের উপর থেকে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হয়। অতঃপর দলের ওয়ার্কিং কমিটি ভারতে উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য বিরতিহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফরওয়ার্ড ব্লক ভারত-বিভক্তির জন্য ১৯৪৭সালের ৩ জুন তারিখের পরিকল্পনার বিরোধী ছিল।
ভারত বিভক্তির অব্যবহিত পরেই ফরওয়ার্ড ব্লককে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আওতামুক্ত স্বাধীন দল বলে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের অভ্যন্তরে মত পার্থক্য দেখা দেয়। লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য অর্জনের পন্থা নিয়েও পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। যাহোক, দল বিভক্ত হয়ে যায়। এর একটি দলের পরিচালনায় ছিলেন সুভাষপন্থী সমর্থকগণ; অপরপক্ষে অন্য দলের নেতৃত্বে ছিলেন মার্কসবাদীগণ। বর্তমানে সর্ব ভারতীয় ফরওয়ার্ড ব্লক সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করছে যা এ দল গঠনের মূলে ছিল।
তৎকালীন ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে বর্তমান ফরওয়ার্ড ব্লক, জাতীয়তাবাদী সুভাষের ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আজকের মার্ক্সবাদী মনোভাবে আচ্ছন্ন ফরওয়ার্ড ব্লক, আকাশ পাতাল তফাৎ। সময়ের সাথে সব কিছুই পরিবর্তন হয় ফরওয়ার্ড ব্লকও এর ব্যাতিক্রমী নয়।
তা যাই হোক, আজকের দিনেই সুভাষচন্দ্র বসু , ফরওয়ার্ড ব্লকের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। আজ ৩রা মে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতিষ্ঠান দিবস। তবে সুভাষচন্দ্র বসু , সুভাষ বোস হয়েই ফরওয়ার্ড ব্লককে নেতৃত্ব দিয়েছেন নেতাজী হয়ে নেতৃত্ব দিতে তিনি পারেননি। পারেননি একপক্ষে ভালোই বলা চলে ,কারণ তিনি তো জাতীয় নেতা , আমাদের দেশের গৌরব নেতাজী, তিনি শুধু কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন। তিনি বিশ্ব সেরা ইতিহাস বন্দিত নেতা। আমাদের প্রিয় নেতাজী।
লেখাঃ-গৌরব মিশ্র
তথ্যঃ-ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment