Skip to main content

•••গাজন উৎসব•••

"গাজন"-এটি একটি লৌকিক উৎসব। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম উৎসব হল এই 'গাজন'।এই উৎসব শিব, নীল,মনসা ও ধর্মঠাকুর বা ধর্মরাজ পূজাকেন্দ্রীক উৎসব।


বাংলা "গাজন" শব্দটি "গর্জন" শব্দ থেকে বুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচন্ড গর্জন করে বলে এই উৎসবের এরূপ নামকরণ। এছাড়াও বাংলায় এ বিষয়ে আরো একটি মত রয়েছে, "গা" শব্দের অর্থ গ্রাম এবং "জন" শব্দের অর্থ জনসাধারণ, গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের এরূপ নামকরণ হয়।


বাংলায় যেহেতু অনেক লৌকিক দেবতার পূজাকে কেন্দ্র করে গাজন অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন পূজার বিভিন্ন সময়ে গাজন অনুষ্ঠিত হয়। যেমন-শিবের বা নীলের গাজন হয় চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে, আবার মনসা ও ধর্মরাজের গাজন হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে। এসবের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত হলো শিবের গাজন। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। গাজন সাধারণত তিন দিন ধরে চলে।


লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। এই গাজনের ইতিহাসের দিকে বিশেষভাবে নজর রাখলে আমরা কিছু বিষয়ে অবগত হতে পারি,যেমন- শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি গাজন হলেও প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবে সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবীর সহিত বিবাহ দেওয়া এই উৎসবের উদ্দেশ্য। এই লৌকিক উৎসবের সহিত শুধু পৌরাণিক দেবতাদের কাহিনী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সূর্যের সহিত পৃথিবীর বিবাহ দেওয়ার প্রধান কারণ হল সূর্যকে ঠান্ডা করা। বুঝিয়ে বললে বিষয়টি এরকম যে, চৈত্র মাস হইতে বাংলায় সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে, এই সময় থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের প্রচণ্ড তেজ প্রশমন ও শীঘ্রই বৃষ্টিপাতের জন্য বিবাহ দেওয়া। বাঙ্গালীদের মতে বিবাহের পর পুরুষদের রাগ তেজ কিছুটা স্ত্রী নির্ভর হয়ে যায়। ঠিক তেমনি কল্পনা করে বাংলার মূলত কৃষিজীবী মানুষেরা সূর্যের সহিত পৃথিবীর বিবাহ দেন। বছরের পর বছর এই পরম্পরাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই ঘটনার সহিত পৌরাণিক দেবতাদের কাহিনী জুড়ে দেওয়া হয়। তেমনি শিব ও দেবী হরকালীর বিবাহ হয় এই শিবের গাজন উৎসবে।

শিব ও গৌরী


আবার একটু ভালো করে বিষয়টিতে আলোকপাত করলে,আরো কিছু তথ্য সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এই গাজন মূলত রাঢ় বাংলার লৌকিকসংস্কৃতি। এই উৎসব নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যেমন শিবের গাজনে যে শিবকে সারাবছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই , জাত নেই, কুল নেই,উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা- অবহেলা নেই। এদিন সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতা, শিবকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। এই উৎসবে শোভাযাত্রায় হয়। দুজন সন্ন্যাসী শিব এবং গৌরী সাজেন, বাকিরা নন্দী,ভৃঙ্গী, ভুত-প্রেত, দৈত্য-দানব, প্রভৃতির সং সেজে নৃত্য করেন। শিবের নানা লৌকিক ছড়া, গান ইত্যাদিও করা হয় এই উৎসবে। এছাড়াও গাজনে কালির নাচ হল অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য হয়, চরক হয় ইত্যাদির মাধ্যমে গাজন হয়ে ওঠে বাংলা অন্যতম একটি উৎসব। একইভাবে শিবের মতো মনসা, ধর্মরাজ ইত্যাদি লৌকিক দেবতার পূজাকে কেন্দ্র করে গাজন অনুষ্ঠিত হয়।


এ বিষয়ে থেকে আমরা অবশ্যই এটা বুঝতে পারছি যে শিবের গাজন হোক বা ধর্মের গাজন , "গাজন" উৎসবের মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের মিলন ঘটে।যে মিলন ভুলিয়ে দেয় জাতপাত, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ। এই মিলন বাংলার ঐতিহ্যকে যুগের পর যুগ ধরে করে তুলেছে মহান ও মহানুভব।

ইতিহাসে বাংলা ফেসবুক পেজ

লেখাঃ-গৌরব মিশ্র

তথ্যসূত্রঃ- ১) উইকিপিডিয়া

                ২) নবদ্বীপ মহিমা-কান্তি চন্দ্র রাঢ়ি

Comments

Popular posts from this blog

"বীরভূমের হাজারদুয়ারী": হেতমপুর

 আজ সকলকে শোনাবো বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের নিকট " হেতমপুর "নামক একটি জনপদের গল্প। এখানে আজও বর্তমান ৯৯৯ টি দরজা বিশিষ্ট রাজ অট্টালিকা। যা " বীরভূমের হাজার দুয়ারী " নামেও পরিচিত।এই হেতমপুরের পূর্ব নাম ছিল রাঘবপুর, এই নামের পরিবর্তনের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। রাজনগরের জমিদার রাঘব রায়ের নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানটির। রাজনগর রাজাদের অনুরোধে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান এসেছিলেন, বিদ্রোহী রাঘব রায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাঘব রায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে, হাতেম খান এই জায়গার জমিদার হয়ে ওঠেন এবং এর নামকরণ করা হয় হাতেমপুর। সময়ের সাথে সাথে এটি হয়ে উঠেছে হেতমপুর। যদিও এ ঘটনা বঙ্গে নতুন নয়।  এবার জানবো সেই রাজপরিবার ও তার ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজবাড়ি সম্পর্কে।  হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যুর পর বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান...

•••ফরওয়ার্ড ব্লক ও নেতাজী•••

সুভাষ চন্দ্র বসু তখন শুধুই জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ বোস,তখনও তিনি নেতাজী হননি।১৯৩৯-এ কংগ্রেসের মধ্যে থেকে সুভাষ বোস ঘোষণা করেন যে, ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি দল গঠন করবেন। নতুন দল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল মতাদর্শের অনুসারী সংস্কারপন্থীদের সর্বজনগ্রাহ্য ঐকমত্যের বৃহত্তম পদক্ষেপের প্রতিফলনসহ দেশের সকল সংস্কারপন্থি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল শক্তিকে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সকল সংস্কারপন্থী, অর্থাৎ সমাজবাদী, সাম্যবাদী এবং কিষাণসভাপন্থিগণ তাঁর আহবানে সাড়া দেবেন।১৯৩৯ সালে ৩রা মে "ফরওয়ার্ড ব্লক" সুভাষচন্দ্র বসুর হাত ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়। সুভাষ বসু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ডানপন্থী শক্তির আপোষ নীতির বিরোধী ছিলেন। এ ডানপন্থী শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করতে ইচ্ছুক ছিল না। যুদ্ধের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে তিনি সুপারিশ করেন যে, ব্রিটেনকে ছয় মাসের একটি চরমপত্র প্রদান করে কংগ্রেসের উচিৎ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা। যাহোক, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাঁর সুপারিশ ও হুঁশিয়ারিকে প্...