Skip to main content

ভালকি মাচান: জঙ্গল মধ্যস্থিত দুর্গ


বোলপুর থেকে মাত্র ৩০ কিমি ও গুসকরা রেল স্টেশন থেকে মাত্র ২২ কিমি দূরে অবস্থিত ভাল্কির জঙ্গল। সেই জঙ্গলের কিনারায় রয়েছে ভালকি মাচান বা ভাল্কির দুর্গ। 

ভাল্কির দুর্গ। 


চারদিকে চারটি সুরকি দিয়ে গাঁথা পোড়া ইঁটের তৈরি উঁচু মিনার দণ্ডায়মান এবং মাঝখানের মিনারটি এগুলির তুলনায় বেশি উঁচু। পাঁচটি স্তম্ভের মাঝখানে স্বল্প পরিসরে কুয়োর মত একটি গর্ত দেখা যায়, যা বর্তমানে নিরাপত্তার কারণে লোহার জালি দিয়ে ঢাকা। এটি আসলে একটি সুড়ঙ্গপথ। এই সুরঙ্গ দুর্গাপুর সিটিসেন্টারের সুড়ঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত।শোনা যায়, যা দেবী চৌধুরানী এবং অন্যান্য বিপ্লবীরা ব্যবহার করতেন এবং এই সুড়ঙ্গ দিয়ে নাকি ঘোড়া ছুটিয়েও যাওয়া যেত। কেউ বলে, মিনার গুলি শত্রুদের উপর লক্ষ্য রাখার জন্য বানানো হয়েছিল। আবার কারোর মতে, এগুলি বিমানের দিকনির্দেশ করত‌। এছাড়াও নানা জনশ্রুতিও শোনা যায় এই ভালকি মাচান ও তার নামকরণকে ঘিরে।



ঐতিহাসিক সুরঙ্গ


একসময় এই জঙ্গলে ভালুক ছিল এবং সেই ভালুক শিকারের জন্যই রাজা ভল্লু এই মাচান বানিয়েছিলেন, সেই অনুসারেই এর নাম হয় ভালকি মাচান। সবচেয়ে প্রচলিত জনশ্রুতিটি হল, সুরাটের কোন এক রাজা তাঁর অন্তঃসত্ত্বা রানীকে নিয়ে তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়য়ে আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় রানীর প্রসব বেদনা শুরু হলে জঙ্গলে তাঁবু ফেলে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়।  রানী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু জন্মের বহুক্ষণ পর পর্যন্ত সেই সদ‍্যোজাতর সাড়াশব্দ না মেলায় রাজা ও তাঁর পারিষদরা তাকে মৃত ভেবে তাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়েই রওনা দেন। ঘটনার পরদিন কোন এক স্থানীয় ব্রাহ্মণ শিশুর ক্রন্দন শব্দ পেয়ে শব্দের উৎস সন্ধানে জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে দেখেন একটি মেয়ে ভাল্লুক শিশুটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে বসে তাকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ব্রাহ্মণ কাছে গেলে ভাল্লুকটি শিশুকে ফেলে পালায় এবং সেই ব্রাহ্মণ সেই শিশুটিকে বড় করে তোলেন এবং এই শিশুটির নাম রাখা হয় ভল্লুপদ, কারন কথিত আছে যে এই শিশুটি মানুষের সংস্পর্শে এসে মানুষের মতো আচরন করলেও এই শিশুর পা ছিল অস্বাভাবিক লম্বা এবং সে ভাল্লুকের মতো পা টেনে হাঁটত। পরবর্তীতে এই শিশুই নিজ পরাক্রমে আউসগ্রাম জঙ্গলমহল ও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজের রাজত্ব বিস্তার করেন ও রাজা ভল্লু নামে পরিচিত হন। রাজার নামের সূত্র ধরেই জঙ্গলের নাম হয় ভালকির জঙ্গল। 

সুউচ্চ পাঁচটি মিনার


তবে, রূপকথাকে পাশে রেখে বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাসকে দেখলে পাওয়া যায় যে, উগ্রক্ষত্রিয় বর্ধমানের রাজারা বর্গী আক্রমণ থেকে বাঁচতে রাজ্যের সীমানার চারদিকে শত্রুর উপর নজর রাখার জন্য অনেকগুলো দুর্গ বা গড় তৈরি করেছিলেন এবং এই ভালকির মাচানও সেইরকম গড় ভিন্ন আর কিছু নয়।




এছাড়াও এই অঞ্চলের দুর্গাপূজা সংক্রান্ত একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস জানা যায়। ভল্লু রাজার প্রপৌত্র রাজা মহেন্দ্র তাঁর মহিষী অমরাবতীকে স্মরনীয় করে রাখতে প্রাচীন গোপভূমে অমরাবতী নামে একটি দুর্গ স্থাপন করেন। রাজা মহেন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাটোয়ার খাজুরডিহির জমিদার জগৎ সিং এর বাড়ি থেকে হরণ করে আনেন প্রাচীন আমলের কষ্টি পাথরের সিংহবাহিনী মূর্তিটি। এবং এই অমরাবতীতেই দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । এখানে দেবী 'শিবাখ্যা' নামেই পরিচিত। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে শিবাখ‍্যা দেবীর পুজো চলে আসছে। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন আজও সেখানে রীতি মেনে ১০০৮ টি বেলপাতা দিয়ে মায়ের আরাধনা করা হয়। এই পুজো আনুমানিক ১৩০ বছরের পুরোনো।


বর্তমানে এই ভালকির জঙ্গলের পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য এখানে পাকা রাস্তার কাছাকাছিই 'অরন‍্যসুন্দরী' নামে একটি মনোরম রিসর্ট তৈরি হয়েছে। রিসোর্ট থেকে ভালকি মাচান দৃশ্যমান। শুধু পাকা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা কিছু স্বল্প সংখ্যক যানবাহনের আওয়াজ ছাড়া এই কোলাহলশূন্য স্থানে শান্তি সদা বিরাজমান। জঙ্গলের মধ্যে ১০-১৫ টি বাড়ি নিয়ে দূরে দূরে স্থানীয় আদিবাসীদের ছোট ছোট এক একটি গ্রাম। রিসর্টে বিদ্যুৎ থাকলেও জঙ্গলে সন্ধ্যা নামলে গোটা জঙ্গল ডুবে যায় অন্ধকারে। জঙ্গলের মধ্যে রিসোর্ট ছাড়া আর সেরকম কোনো বাড়ি নেই। এখানকার মূল আকর্ষণ হলো সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের বুকে আলো নিয়ে জেগে থাকা অরণ্যসুন্দরীতে দূর থেকে ভেসে আসে স্থানীয় আদিবাসীদের ধামসা-মাদলের আওয়াজ। এমনকি আগে থেকে বলে রাখলে রিসর্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় রিসর্টে আদিবাসী লোকনৃত্য ও লোকসঙ্গীতের আয়োজনও সম্ভব। রিসর্ট এর মধ্যে রয়েছে একটি জলাশয় এবং মনোরম উদ্যান। জলাশয়ে রয়েছে বোটিংয়ের ব্যবস্থা‌। জঙ্গলের কোলে শান্ত সবুজের নীরবতা ও স্নিগ্ধতায় ব‍্যস্ত-ক্লান্ত মন আরাম অনুভব করবেই। রিসর্টে থাকতে হলে আগে থেকে বুকিং করা আবশ্যক। 

অরন‍্যসুন্দরী


অরণ্যসুন্দরী রিসোর্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে ----

দূরভাষ:০৩৪৫২-২০০৬৪

চলভাষ: ৯১৫৩৪২০১৩৩ / ৯৪৩৪৫৩৭৫৪৫


লেখা: কোয়েল দত্ত

তথ্য সংগ্রহ: ইন্টারনেট

ছবি: ইতিহাসে বাংলা-র নিজস্ব চিত্র।


এরকম আরও বাংলার অজানা অলিখিত ইতিহাসকে জানতে ইতিহাসে বাংলা  ব্লগটিকে ফলো করুন এবং ইতিহাসে বাংলা ফেসবুক পেজে লাইক করুন।

ইতিহাসে বাংলা-র ফেসবুক পেজ

ইতিহাসে বাংলা-র ফেসবুক পেজে-" মাচান"





Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

"বীরভূমের হাজারদুয়ারী": হেতমপুর

 আজ সকলকে শোনাবো বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের নিকট " হেতমপুর "নামক একটি জনপদের গল্প। এখানে আজও বর্তমান ৯৯৯ টি দরজা বিশিষ্ট রাজ অট্টালিকা। যা " বীরভূমের হাজার দুয়ারী " নামেও পরিচিত।এই হেতমপুরের পূর্ব নাম ছিল রাঘবপুর, এই নামের পরিবর্তনের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। রাজনগরের জমিদার রাঘব রায়ের নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানটির। রাজনগর রাজাদের অনুরোধে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান এসেছিলেন, বিদ্রোহী রাঘব রায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাঘব রায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে, হাতেম খান এই জায়গার জমিদার হয়ে ওঠেন এবং এর নামকরণ করা হয় হাতেমপুর। সময়ের সাথে সাথে এটি হয়ে উঠেছে হেতমপুর। যদিও এ ঘটনা বঙ্গে নতুন নয়।  এবার জানবো সেই রাজপরিবার ও তার ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজবাড়ি সম্পর্কে।  হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যুর পর বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান...

মমতাময়ী রাণীমা:শক্তিস্বরূপিনী রাণী রাসমণি।

 " নারী " সৃষ্টির আধার,"নারী"-ই শক্তি, "নারী"-ই পরমাপ্রকৃতি।আবার এই নারী যখন একাধারে হয় দেশপ্রেমিক,আধ্যাত্মিক মনভাবাপন্না,সেই সঙ্গে হয় মমতাময়ী ও ঈশ্বরের আর্শীবাদ ধন‍্যা,তখন সেই নারী হয়ে ওঠে অনন্যা। আমার উৎসাহী পাঠকবর্গকে আজ এমনই এক বিরল প্রকৃতির নারীর জীবনবৃত্তান্ত শোনাবো।যাঁর মনে ছিল গভীর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের জন্য ছিল পরম মমতা এবং চোখে ছিল অদম্য সাহস। পরমাত্মার অশেষ কৃপায় ও তাঁর নিজ গুণে তিনি হয়ে উঠেছেন লোকমাতা রাণী রাসমণি। মহিয়সী এই নারী একদিকে যেমন ছিলেন একজন সমাজ সেবিকা,ঠিক তেমনই অন‍্যদিকে  তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণা,ঈশ্বরপ্রেমী মানুষ। রাণী রাসমণি ইতিহাসে বাংলা ফেসবুক পেজ ১৭৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের 'কোনা' গ্রামে এক দরিদ্র কৃষিজীবী  স্বর্গীয় হরেকৃষ্ণ দাশ ও স্বর্গীয়া রামপ্রিয়া দাশির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।রামপ্রিয়া দেবী ভালোবেসে কন‍্যার নাম " রাণী ",কিন্তু পরে প্রতিবেশীদের দৌলতে তা হয়ে ওঠে " রাণী রাসমণি "। রাসমণি মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার জানবাজারের জমিদার বাবু প্রিতরাম দাসের সুযোগ্য প...

•••ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যা•••

পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লক এর ক্ষীরগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা যোগাদ্যা।বাংলার অন্যতম একটি সতীপীঠ হলো এই ক্ষীরগ্রাম। এখানে দেবী সতীর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি পতিত হয়েছে। দেবী রূপে মহিষাসুরমর্দিনী। দেবী মূর্তি কষ্টি পাথরের তৈরী। এখানে দেবী পাতালবাসীনি।মা যোগাদ্যার মূর্তিটি সারাবছর ক্ষীরদিঘির জলে নিমজ্জিত থাকে। বৈশাখী সংক্রান্তি সময় মায়ের আবির্ভাব দিবস বা বিশেষ পুজোর সময় মাকে জল থেকে তুলে এনে চলে পূজো। প্রাচীন দেবী মূর্তি ক্ষীরগ্রামের পূজিত প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনো কারনে হারিয়ে গেছিল। মোটামুটি ২০০ বছর আগে, বর্ধমান মহারাজ কীর্তিচন্দ্র নির্দেশে দাঁইহাটের নবীন ভাস্কর নতুন যোগাদ্যা মূর্তিটি তৈরি করেন। এই নবীন ভাস্করই হলেন তিনি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দিরের মা ভবতারিণীর মূর্তি নির্মাণ করেছেন। পরবর্তীকালে ক্ষীরদিঘী সংস্কারের সময় পুরনো মূর্তিটি পাওয়া যায়। বর্তমানে পুরনো মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি এবং নবীন ভাস্কর এর তৈরি নবীন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, দুটি ভিন্ন মন্দিরে পূজিত হয়। মায়ের মন্দিরটিও বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচন্দ্রর নির্দেশে নির্মান করা হয়। মন্দিরের তোরণটিও বেশ নজরক...