Skip to main content

"বীরভূমের হাজারদুয়ারী": হেতমপুর

 আজ সকলকে শোনাবো বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের নিকট "হেতমপুর"নামক একটি জনপদের গল্প। এখানে আজও বর্তমান ৯৯৯ টি দরজা বিশিষ্ট রাজ অট্টালিকা। যা "বীরভূমের হাজার দুয়ারী" নামেও পরিচিত।এই হেতমপুরের পূর্ব নাম ছিল রাঘবপুর, এই নামের পরিবর্তনের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। রাজনগরের জমিদার রাঘব রায়ের নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানটির। রাজনগর রাজাদের অনুরোধে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান এসেছিলেন, বিদ্রোহী রাঘব রায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাঘব রায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে, হাতেম খান এই জায়গার জমিদার হয়ে ওঠেন এবং এর নামকরণ করা হয় হাতেমপুর। সময়ের সাথে সাথে এটি হয়ে উঠেছে হেতমপুর। যদিও এ ঘটনা বঙ্গে নতুন নয়। 



এবার জানবো সেই রাজপরিবার ও তার ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজবাড়ি সম্পর্কে। 


হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যুর পর বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান হেতমপুরের জাঁদরেল রায়বংশের জমিদারিতে। নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে তিনি একটা সময়ে সেরেস্তার দায়িত্ব পান। আর্থিকভাবেও ধনী হয়ে জমিদারির ইজারা কিনে সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন। একটা সময়ে তাঁর প্রতিপত্তি রায়দেরও ছাড়িয়ে যায়। এমনকি মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে তিনি কিছু মহল আর জমিদারি কেনেন। এই রাধানাথ চক্রবর্তী ছিলেন হেতমপুর রাজ পরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বীরভূম রাজের ১৯ টি মৌজার ইজারা নিয়ে ক্রমে মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত করেন। এই সময় তিনি রাজনগরের সাথে এক যুদ্ধ জয়ী হয়ে বীরভূম এবং আশেপাশের অঞ্চলের স্বাধীন বাঙালি রাজা হন। শেষ পর্যন্ত তিনি রায় পরিবারকে তারই বেতনভুক্ত করে তোলেন। ১৮৩৮ সালে তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পত্তিগত আয় ছিল ২০,০০০০ রুপি। ব্রিটিশ শাসকদের বশ্যতা স্বীকার করায় তিনি ‘মহারাজা’ উপাধি পান।



রাধানাথ মারা গেলে তাঁর বড়ো ছেলে বিপ্রচরণ জমিদারিকে আরো বিত্তশালী ও সমৃদ্ধশালী করে তোলেন। রাজা বিপ্রচরন ছিলেন সর্বাধিক সফল শাসক। বাবার মৃত্যুর সাত বছরের মধ্যেই তিনি তাঁর রাজ্যকে বীরভূমের বৃহত্তম স্থানে পরিণত করেন। তিনি রাজনগর রাজ পরিবারের বিবি রাজীবুন্নিসা কে ৫০,০০০ ঋণের বিনিময়ে লাভ করে আরও জমি করায়ত্ত করেন। সাঁওতাল পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলিও তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জানা যায় বিপ্রচরণ সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে বেশ অবদান রেখেছিলেন। তার ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি মেতে থাকতেন। তাঁর ছেলে রামরঞ্জন বানিয়েছিলেন হেতমপুরের সেই বিশাল প্রাসাদ।  

১৮৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এই রামরঞ্জন চক্রবর্তী ব্রিটিশ সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। যার ফলে ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার খুশি হয়ে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দুই বছর পরে তাঁকে লর্ড লিটন ‘রাজা বাহাদুরের’ পদে উন্নীত করেন। ১৯১২ সালে তিনি মহারাজার পদে উন্নীত হন।

১৯০৫ সালে রামরঞ্জন চক্রবর্তী রাজবাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। তাই এই বাড়িটাকে ‘রঞ্জন প্যালেস’ নামেও ডাকা হয়। ইংরেজ সরকারের সঙ্গে এই রাজপরিবারের সখ্যতা অবশ্য বেশ পুরোনো। জানা যায় কাজী নজরুল ইসলাম বেশ বহুদিন এই প্রাসাদেই আত্মগোপন করেছিলেন। যদিও কিছুদিন বাদে গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

রঞ্জন প্যালেস
ইতিহাসে বাংলা ফেসবুক পেজ


 দুর্গের মতো দেখতে এই বিশাল প্রাসাদের দরজার সংখ্যা ৯৯৯টি। মুর্শিদাবাদের নবাব হুমায়ুন জা-র তৈরি করা হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সম্মান যাতে অক্ষুন্ন থাকে, তার জন্য হাজারদুয়ারির থেকে একটা দরজা কম রাখা হয়েছিল এই বাড়িতে। তবে স্থানীয় লোকজনের মুখে এই প্রাসাদের নাম হয়েছিল ‘'বীরভূমের হাজারদুয়ারি’'। হেতমপুরের রাজ পরিবারের আবাস এই অট্টালিকা।




হেতমপুর গেলে আমরা যে হলুদ রঙের বিশাল আকারের অট্টালিকা দেখি সেটি হচ্ছে"রঞ্জন প্যালেস" কিন্তু এর অদূরেই পুরো রাজবাড়ীর কিছু অংশ এখনও বর্তমান।


কি মন চাইছে নাকি "বীরভূমের হাজারদুয়ারী"দেখতে ?মন যদি বাংলাকে অনুভব করতে এবং বাংলার ঐতিহ্যকে চাক্ষুষ করতে চয় তাহলে চলে আসুন, ঘুরে যান হেতমপুর। শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র ৩৫ কিমি দূরে হেতমপুর। বোলপুর থেকে গেলে দুবরাজপুরের ঠিক আগেই হেতমপুর মোড় ।মেইন রোড থেকে ২ কিমি ভিতরে গেলে হেতমপুর রাজবাড়ী।


লেখা: গৌরব মিশ্র 

তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

•••গাজন উৎসব•••

" গাজন "-এটি একটি লৌকিক উৎসব। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম উৎসব হল এই 'গাজন'।এই উৎসব শিব, নীল,মনসা ও ধর্মঠাকুর বা ধর্মরাজ পূজাকেন্দ্রীক উৎসব। বাংলা " গাজন " শব্দটি " গর্জন " শব্দ থেকে বুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচন্ড গর্জন করে বলে এই উৎসবের এরূপ নামকরণ। এছাড়াও বাংলায় এ বিষয়ে আরো একটি মত রয়েছে, " গা " শব্দের অর্থ গ্রাম এবং " জন " শব্দের অর্থ জনসাধারণ , গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের এরূপ নামকরণ হয়। বাংলায় যেহেতু অনেক লৌকিক দেবতার পূজাকে কেন্দ্র করে গাজন অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন পূজার বিভিন্ন সময়ে গাজন অনুষ্ঠিত হয়। যেমন-শিবের বা নীলের গাজন হয় চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে, আবার মনসা ও ধর্মরাজের গাজন হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে। এসবের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত হলো শিবের গাজন। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। গাজন সাধারণত তিন দিন ধরে চলে।...

•••ফরওয়ার্ড ব্লক ও নেতাজী•••

সুভাষ চন্দ্র বসু তখন শুধুই জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ বোস,তখনও তিনি নেতাজী হননি।১৯৩৯-এ কংগ্রেসের মধ্যে থেকে সুভাষ বোস ঘোষণা করেন যে, ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি দল গঠন করবেন। নতুন দল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকল মতাদর্শের অনুসারী সংস্কারপন্থীদের সর্বজনগ্রাহ্য ঐকমত্যের বৃহত্তম পদক্ষেপের প্রতিফলনসহ দেশের সকল সংস্কারপন্থি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল শক্তিকে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সকল সংস্কারপন্থী, অর্থাৎ সমাজবাদী, সাম্যবাদী এবং কিষাণসভাপন্থিগণ তাঁর আহবানে সাড়া দেবেন।১৯৩৯ সালে ৩রা মে "ফরওয়ার্ড ব্লক" সুভাষচন্দ্র বসুর হাত ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়। সুভাষ বসু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ডানপন্থী শক্তির আপোষ নীতির বিরোধী ছিলেন। এ ডানপন্থী শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করতে ইচ্ছুক ছিল না। যুদ্ধের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে তিনি সুপারিশ করেন যে, ব্রিটেনকে ছয় মাসের একটি চরমপত্র প্রদান করে কংগ্রেসের উচিৎ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা। যাহোক, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাঁর সুপারিশ ও হুঁশিয়ারিকে প্...