Skip to main content

মমতাময়ী রাণীমা:শক্তিস্বরূপিনী রাণী রাসমণি।

 "নারী" সৃষ্টির আধার,"নারী"-ই শক্তি, "নারী"-ই পরমাপ্রকৃতি।আবার এই নারী যখন একাধারে হয় দেশপ্রেমিক,আধ্যাত্মিক মনভাবাপন্না,সেই সঙ্গে হয় মমতাময়ী ও ঈশ্বরের আর্শীবাদ ধন‍্যা,তখন সেই নারী হয়ে ওঠে অনন্যা।

আমার উৎসাহী পাঠকবর্গকে আজ এমনই এক বিরল প্রকৃতির নারীর জীবনবৃত্তান্ত শোনাবো।যাঁর মনে ছিল গভীর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের জন্য ছিল পরম মমতা এবং চোখে ছিল অদম্য সাহস। পরমাত্মার অশেষ কৃপায় ও তাঁর নিজ গুণে তিনি হয়ে উঠেছেন লোকমাতা রাণী রাসমণি। মহিয়সী এই নারী একদিকে যেমন ছিলেন একজন সমাজ সেবিকা,ঠিক তেমনই অন‍্যদিকে  তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণা,ঈশ্বরপ্রেমী মানুষ।

রাণী রাসমণি
ইতিহাসে বাংলা ফেসবুক পেজ


১৭৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের 'কোনা' গ্রামে এক দরিদ্র কৃষিজীবী  স্বর্গীয় হরেকৃষ্ণ দাশ ও স্বর্গীয়া রামপ্রিয়া দাশির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।রামপ্রিয়া দেবী ভালোবেসে কন‍্যার নাম "রাণী",কিন্তু পরে প্রতিবেশীদের দৌলতে তা হয়ে ওঠে "রাণী রাসমণি"।

রাসমণি মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার জানবাজারের জমিদার বাবু প্রিতরাম দাসের সুযোগ্য পুত্র বাবু রাজচন্দ্র দাসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, সালটা ছিলো ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ। শোনা যায়, বাবু রাজচন্দ্র দাস কোন এক ব্যবসায়িক কাজে একদিন ত্রিবেণী তে যাচ্ছিলেন, যেতে যেতে তার চোখে পড়ে ১০ বছর বয়সী রানীকে, তাঁর রূপ ও মুখের লাবণ্য দেখে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত যুবক রাজচন্দ্র দাস প্রেমে পড়ে যান। সেদিন বাবু রাজচন্দ্র দাস হালিশহর হতেই জানবাজার ফিরে আসেন। এর পরেও তিনি আরও বেশ কয়েকবার হালিশহরে রাসমনির গ্রামে এসেছিলেন। সেখানে তিনি রাসমণির রূপ ও লাবণ্য ছাড়াও তেজস্বিনী এবং দয়ালু রূপের সাথে পরিচিত হন। যার ফলে রানীকে আরও গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন। যার পরিণতি স্বরূপ হালিশহরের মাহিষ্য পরিবারের ছোট্ট কন্যা হয়ে ওঠেন জানবাজারের রাণীমা- শ্রীমতি রানী রাসমণি দাসী।

রাসমণি ও রাজচন্দ্র দুজনেই ভীষণ দয়ালু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁদের বেশির ভাগ সম্পদ সামাজিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান ব্যয় করে দিতেন। কোনো জন-প্রাণী তাদের দয়া ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতো না। হাজার বিপত্তির ফলেও তাঁরা দুজনে কোনদিনই মানুষের সেবা বন্ধ করেননি।রানীমা তাঁর স্বামীর সহায়তায় অনেক জনহিতৈষী কাজ করেছিলেন। রানী রাসমণি তার বিবিধ জনহিতকর কাজের মাধ্যমে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেন। কলকাতাবাসীদের গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য তিনি কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট (বাবু রাজচন্দ্র দাসের স্মৃতি রক্ষার্থে), আহিরীটোলা ঘাট, নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেন। এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর অবদান যথেষ্ট ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী বর্তমানে যেটি ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার এবং হিন্দু কলেজের বর্তমানে যেটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কালে  তিনি প্রভূত অর্থ সাহায্য করে ছিলেন।

এক সময় ইংরেজ সরকার গঙ্গায় জেলেদের মাছ ধরার উপর জলকর আরোপ করেছিলেন। নিরুপায় হয়ে জেলেরা বাবু রাজচন্দ্র দাসের কাছে তাদের কষ্টের কথা বলেন। এই খবর যথাক্রমে পৌঁছায় রাণীমার কানে, রানী তাঁর স্বামীর সাথে আলোচনায় বসেন এবং রাণীর কথামতো রাজচন্দ্র দাস ইংরেজ সরকারকে ১০০০০ টাকা (রুপি) দিয়ে ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার গঙ্গা ইজারা নিলেন। যেইমাত্র ইজারার দলিল এবং কাগজপত্র রাণীমার হাতে এসে পৌছালো তখনই তিনি জেলেদের এক অভিনব হুকুম দিলেন। রাণীমার হুকুমে রাতারাতি লোহার শিকল দিয়ে ইজারা নেওয়া অংশটুকু ঘিরে ফেলা হল। জেলেরা শুধু ইজারা নেওয়া অংশেই মাছ ধরবে।এই ঘটনার ফলে ঘাটগুলোতে নৌ-চলাচল বন্ধ হলে, কোম্পানির বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ গুলোও আটকে গেল।

ভাবা যায়! কলকাতার এক রানী কিনা ব্রিটিশরাজের সাথে টক্কর দিচ্ছে।  এহেন কান্ড এর আগে কখনো কলকাতাবাসী দেখেননি। যথারীতি রানীকে সর্বোচ্চ আদালতে তলব করা হলো এবং আদেশ দেওয়া হলো লোহার শিকল খুলে দিতে। রাণীমা ছিলেন প্রজাদরদী, হাজার বাধা-বিপত্তি এলেও,প্রজাদের স্বার্থ ছাড়া অন্যকিছু তাঁর চোখে পড়ে না। তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে- কোম্পানির জাহাজ চলাচলের কারণে জেলেদের জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছেরা এই এলাকায় আসে না। এতে প্রজাদের ক্ষতি এবং রানীর ব্যবসায়িক ক্ষতি। এক্ষতি তিনি মেনে নেবেন না। তাছাড়া এমন কাজ তিনি ইচ্ছা করে করেননি বরং কোম্পানি থাকে বাধ্য করেছে। এই বাঁধ তিনি তখনই তুলবেন যখন তাঁর প্রজাদের উপর আরোপিত কর মুকুব করা হবে।

রাণীমার বুদ্ধিমত্তা এবং যুক্তির কাছে কোম্পানির সমস্ত মারপ্যাঁচ বিফলে গেল। জেলেদের ওপর সকলপ্রকার কর উঠিয়ে নেওয়া হল এবং রানীকে ইজারা বাবদ ১০ হাজার টাকা(রুপি) ফেরত দেওয়া হল। এরকম ভাবে বেশ কয়েকবার রানী তাঁর বুদ্ধি, যুক্তি, অর্থ দিয়ে ব্রিটিশরাজ কে টক্কর দিয়েছিলেন এবং পরাস্তও করেছিলেন।

কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ে হলেও রাসমনির পিতা হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন শিক্ষিত এবং মানসিকতার দিক থেকেও আর দশটা মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত। বাবার হাতেই রাসমনির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়, বাবা তাঁকে অনেক গল্প শোনাতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা হরেকৃষ্ণ দাসের বাড়িতে জমায়েত হতো মহাভারত, গীতা, পুরাণ পাঠ শোনার জন্য। ছোট্ট রাণী হারিয়ে যেতেন সেইসব গল্পের মাঝে। এই ভাবেই ধীরে ধীরে তাঁর অন্তরে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার বীজ রোপিত হয়।

বাবু রাজচন্দ্র দাস এবং রানী রাসমণি সহায়তায় রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ করেন, রানী রাসমণি মনেপ্রাণে চাইতেন নারীরা দাসত্ব এবং ধর্মের নামে এঁটে দেওয়া দুর্দশা থেকে মুক্তি পাক। রাণীমা নিজেও সমাজের বাধা না মেনে অন্দরমহলের পর্দার বাইরে বেরিয়ে এসে স্বামীর সাথে নিজের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করতেন।তিনি তাঁর বুদ্ধি, ভালোবাসা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমেই জানবাজারের রানী থেকে হয়ে ওঠেন লোকমাতা রানী রাসমণি

১৮৩৬ সালে ৪৯ বছর বয়সে রাজচন্দ্র দাসের আকস্মিক মৃত্যুতে রানী দিশেহারা হয়ে পড়েন। একদিকে ভালবাসার মানুষটার ছায়া হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত রানী, অন্যদিকে জমিদারি কেড়ে নেওয়ার পারিবারিক ও কোম্পানির ষড়যন্ত্র। কিন্তু রানীর পুত্রসম জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের সহায়তায় খুব শীঘ্রই রাণী শোক ভুলে জমিদারের হিসেবের খাতা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিশাল জমিদারির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে একজন স্বভাবনেত্রী এবং বিচক্ষণ ব্যবসায়ী হিসেবে তুলে ধরেন।

মানবতাবাদী রানী কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেন না, হোক সে চোর, হোক সে ডাকাত অথবা সাধু। ১৮৫১ সালে গঙ্গাসাগর যাওয়ার পথে চন্দননগরের কাছে রানীর বজরায় ডাকাতরা হামলা চালায়। গোলাগুলি শুরু হলে রানী ডাকাত সর্দার কে গোলাগুলি থামাতে বলেন, তারা কি চায় তা জানতে চান। ডাকাত সর্দার ১২ হাজার টাকা (রুপি) দাবি করলে, রানী রাজি হয়ে প্রতিশ্রুতি দেন যে ঠিক সময় পাওনা পেয়ে যাবে কিন্তু এ পাওনা পাওয়ার পর তাদের এ পথ ছেড়ে দিতে হবে। পরদিন লোক মারফৎ প্রতিশ্রুতির টাকা পাঠিয়ে দেন ডাকাত সর্দারের কাছে।

রানী রাসমণি সমাজ সংস্কারক হিসেবেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় কে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন রানী, সেকথা আগেই বলেছি। আবার তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন এর ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগর মহাশয়কেও যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা করেছিলেন।

রানী রাসমণি সবচেয়ে বড় যে সমাজ সংস্কার টি করেছিলেন তা হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে হিন্দুদের মিলন ক্ষেত্রের প্রতীক হলো রানী রাসমনির তৈরি দক্ষিণেশ্বরের জাঁকজমকপূর্ণ কালীমন্দির। রানী রাসমণি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু ধর্মপ্রাণ হলেই বা কি তখনকার দিনে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয় স্থাপনের নিয়ম ছিল না। সেখানে একজন নিম্নবর্ণের নারী তিনি যতই ধর্মপ্রাণ হন বা রাণীমা হোন, তাঁর মন্দির নির্মাণ হিন্দু সমাজের রীতিমতো আন্দোলন তো বটেই আবার বলাবাহুল্য যে উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আত্মমর্যাদা ও সম্মান আদায়ের অধিকারের লড়াই।

আমার পাঠকবর্গকে অনুরোধ করছি, যাতে তারা একটু ধৈর্য ধরে পড়ে। কারণ রানী রাসমনির জীবন থেকে তারা অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করতে পারবে এবং বিশেষত এখন রানী রাসমনির জীবনের যে পর্যায়ের কথা বলব তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শোনো তাহলে, ইতিহাসে কেন রানী রাসমণি স্মরণীয় হলেন, সে কাহিনী।

১৮৪৭ সালের ধনী বিধবা জমিদারনী রানী রাসমণি দেবী অন্নপূর্ণাকে পূজার মানসে কাশিতে তীর্থযাত্রা আয়োজন করেন। চব্বিশটি নৌকা, আত্মীয়-স্বজন, দাস-দাসীর, রসদ সহ সকল প্রস্তুতি শেষ। শোনা যায় যাত্রার পূর্বরাতে রানী দেবী কালীর স্বপ্নদর্শন পান। দেবী তাঁকে বলেন-

          " কাশি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি নয়নাভিরাম মন্দিরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো করো। সেই মূর্তিতেই আবির্ভূত হয়ে আমি পূজা গ্রহণ করব।"

 পরদিন সকালে পরিবারের সকলকে একথা জানান এবং জামাতা মথুরামোহন কে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য গঙ্গাতীরে জমি খুঁজতে বলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে মিলল জমি তাও কিনা এক ইংরেজ সাহেবের জমি। যাইহোক কুড়ি একর সেই জমি, ১৮৪৭ সালে রানী রাসমনি জন হেস্টি-র থেকে আনুমানিক ৪২ হাজার ৫০০টাকা (রুপি) অথবা ৫০ হাজার টাকা (রুপি) দিয়ে কেনেন।

পাঠকদের অনুরোধ করছি, লক্ষ্য করো ভালো করে। জমিটির ইতিহাস অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য নিদর্শন। জমিটির মালিক ছিলেন এক ইউরোপিয়ান, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী জন হেস্টি, ওই জমির একাংশে ছিল মুসলিম গোরস্থান, এখন বর্তমানে সেখানে কালী মন্দির।

তাহলে, পূর্বে যেটি সাহেবান বাগিচা নামে পরিচিত ছিল, রানী রাসমনির উদ্যোগে তা হয়ে উঠল বঙ্গীয় স্থাপত্য-শৈলীর সমারোহে নবরত্ন বিশিষ্ট এক কালী মন্দির। ইতিহাস এক সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্রের সাক্ষী রইল।

১৮৪৭ সালের এই বিরাট মন্দিরের নির্মাণকাজ টালিগঞ্জের রামনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে শুরু হয়। প্রায় আট বছর ধরে কাজ চলার পর ১৮৫৫ সালের ৩১ শে মে, স্নানযাত্রার দিন মহাসমারোহে মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির আরাধ্যা দেবী হলেন "মা ভবতারিণী" ,দেবী কালিকা, পদতলে শিব। মূল মন্দিরটি নবরত্ন বিশিষ্ট, মূল মন্দির ছাড়াও রয়েছে "দ্বাদশ শিবমন্দির" নামে পরিচিত বারোটি আটচালা শিব মন্দির। মন্দিরের উত্তর রয়েছে "শ্রী শ্রী রাধাকান্ত মন্দির" নামে পরিচিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং দক্ষিনে রয়েছে নাট মন্দির। মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোনে কিছু ঘর যা মূলত মন্দিরের কর্মচারীদের জন্য, ভোগ রন্ধন ইত্যাদি কাজের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে সেই ঘর গুলিতে অনেক মহামানবের আগমন হয়েছিল। সেকথাও বলবো তোমাদের, একটু অপেক্ষা করো।

মন্দির নির্মাণ যখন শেষের দিকে, তখন একটা বড়ো বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন রানী। মন্দির নির্মাণ চলছে তাও যেমন-তেমন মন্দির নয়, তখনকার দিনে মন্দির তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় নয় লক্ষ টাকা। তাহলে ভাবো রানী কিরকম এক বিশাল কর্মযজ্ঞে নেমেছিলেন,তাও শুধুমাত্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে। কিন্তু মন্দির যতই জাঁকজমকপূর্ণ হোক, এ যে শূদ্র নারীর তৈরি মন্দির, পুজো করবে কে? কোন ব্রাহ্মণই এই মন্দিরের পুরোহিত হতে রাজি নন। তৎকালীন সমাজে প্রায় এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এ নিয়ে। কলকাতা শহরের মানুষ ভেবে পাইনি সেদিন, যে রানী রাসমণি কি করতে চাইছেন।

যাইহোক, রানী রাসমণিও দমে যাওয়ার পাত্রী নন। তিনি তৎকালীন নামজাদা অনেক পণ্ডিতকে চিঠি লেখেন। প্রায় সবার কাছ থেকেই যখন হতাশাজনক উত্তর পাচ্ছিলেন, তখন হুগলির কামারপুকুরের রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নামক এক গরিব ব্রাহ্মণ রানীকে আশার আলো দেখালেন। তিনি বলেন, এই মন্দিরে উপাসনা করা তখনই সম্ভব যখন রাণীমা মন্দিরটি কোন ব্রাহ্মণ কে উপহার হিসেবে দেবেন এবং মন্দির পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ ধার্য করে তা পুরোহিতের হাতে তুলে দেবেন।

রানী আর দেরি না করে, মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব তুলে দিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাতে, আর দিনাজপুরের জমিদারি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ধার্য করে দিলেন। রামকুমার তাঁর ছোট ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায় বা গদাই কে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির এসে উপস্থিত হন।সাথে নিয়ে আসেন ভাগ্নে হৃদয়কে। রামকুমারকে প্রধান পুরোহিতের আর গদাধর কে মা কালীর সাজসজ্জা ও মন্দির সংক্রান্ত ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরের বছর, রামকুমারের মৃত্যুর পর গদাধর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রূপে নিযুক্ত হন।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ, এই গদাধরই সেই গদাই যিনি পরবর্তীতে মা কালীর কৃপায় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হয়ে ওঠেন। এই সময় থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর শ্রীরামকৃষ্ণদেব এই মন্দিরের অবস্থান করেন। তাঁর সহধর্মিনী সারদা দেবী মন্দির চত্বরের বাইরে নহবৎখানায় অবস্থান করতেন। এই নহবৎখানা এখন সারদা দেবীর মন্দির।

কালক্রমে রানীর এই কালীমন্দির হয়ে ওঠে তার প্রিয় গদাই ঠাকুরের সাধন ক্ষেত্র। এই মন্দিরে কালী সাধক রামকৃষ্ণ প্রবর্তন করলেন, "সর্বধর্ম সমন্বয় নীতি"-র, তাঁর মতে সকল ধর্মই সমান। সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজমান। রানী রাসমণির এই মন্দির তাঁর প্রিয় ছোটো ঠাকুর বা গদাই ঠাকুরের জন্য  পরিণত হয় একটি তীর্থক্ষেত্রে। রামকৃষ্ণদেবের সুযোগ্য শিষ্য নরেন্দ্রনাথ বা স্বামী বিবেকানন্দের অনেক স্মৃতি এই মন্দিরে জড়িত আছে।

রানীর এই মন্দিরে বহু গুণী মানুষ যেমন এসেছেন তেমনই এখনও লক্ষাধিক ভক্তগণের দৈনন্দিন আগমনের ফলে এই মন্দির বিশ্বে উল্লেখযোগ্য মন্দির গুলির মধ্যে একটি। এই মন্দিরের জন্য এবং অসংখ্য জনহিতকর কাজের মাধ্যমে, ইতিহাসে বাংলার এই অনন্যা নারী,রানী রাসমণির নাম স্বর্ণাক্ষরে খদিত আছে।

লেখা:গৌরব মিশ্র(৬ই এপ্রিল,২০২১)

তথ্য সংগ্রহ: ইন্টারনেট।

Comments

  1. ভীষণ সুন্দর লেখনী, অনেক তথ্য পেয়ে সমৃদ্ধ হলাম। ভবিষ্যতের সরণি আরো দীর্ঘায়িত হোক এই কামনা করি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ।সাথে থাকবেন।শেয়ার করবেন।

      Delete
  2. দারুন হয়েছে দাভাই...❤❤

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ।পাশে থেকো।শেয়ার করো।

      Delete
  3. লেখন শৈলী খুব সুন্দর।।আগামী দিনেও সমৃদ্ধ হওয়ার আশা রাখি ।।অনেক শুভকামনা রইল

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ।পাশে থাকবেন।শেয়ার করবেন।

      Delete
  4. baaah! dhonnobad eto Kichu jananor Jonno.... chaliye jao❤️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

"বীরভূমের হাজারদুয়ারী": হেতমপুর

 আজ সকলকে শোনাবো বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের নিকট " হেতমপুর "নামক একটি জনপদের গল্প। এখানে আজও বর্তমান ৯৯৯ টি দরজা বিশিষ্ট রাজ অট্টালিকা। যা " বীরভূমের হাজার দুয়ারী " নামেও পরিচিত।এই হেতমপুরের পূর্ব নাম ছিল রাঘবপুর, এই নামের পরিবর্তনের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। রাজনগরের জমিদার রাঘব রায়ের নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানটির। রাজনগর রাজাদের অনুরোধে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান এসেছিলেন, বিদ্রোহী রাঘব রায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাঘব রায় পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে, হাতেম খান এই জায়গার জমিদার হয়ে ওঠেন এবং এর নামকরণ করা হয় হাতেমপুর। সময়ের সাথে সাথে এটি হয়ে উঠেছে হেতমপুর। যদিও এ ঘটনা বঙ্গে নতুন নয়।  এবার জানবো সেই রাজপরিবার ও তার ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজবাড়ি সম্পর্কে।  হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যুর পর বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান...

•••ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যা•••

পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লক এর ক্ষীরগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা যোগাদ্যা।বাংলার অন্যতম একটি সতীপীঠ হলো এই ক্ষীরগ্রাম। এখানে দেবী সতীর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি পতিত হয়েছে। দেবী রূপে মহিষাসুরমর্দিনী। দেবী মূর্তি কষ্টি পাথরের তৈরী। এখানে দেবী পাতালবাসীনি।মা যোগাদ্যার মূর্তিটি সারাবছর ক্ষীরদিঘির জলে নিমজ্জিত থাকে। বৈশাখী সংক্রান্তি সময় মায়ের আবির্ভাব দিবস বা বিশেষ পুজোর সময় মাকে জল থেকে তুলে এনে চলে পূজো। প্রাচীন দেবী মূর্তি ক্ষীরগ্রামের পূজিত প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনো কারনে হারিয়ে গেছিল। মোটামুটি ২০০ বছর আগে, বর্ধমান মহারাজ কীর্তিচন্দ্র নির্দেশে দাঁইহাটের নবীন ভাস্কর নতুন যোগাদ্যা মূর্তিটি তৈরি করেন। এই নবীন ভাস্করই হলেন তিনি দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দিরের মা ভবতারিণীর মূর্তি নির্মাণ করেছেন। পরবর্তীকালে ক্ষীরদিঘী সংস্কারের সময় পুরনো মূর্তিটি পাওয়া যায়। বর্তমানে পুরনো মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি এবং নবীন ভাস্কর এর তৈরি নবীন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, দুটি ভিন্ন মন্দিরে পূজিত হয়। মায়ের মন্দিরটিও বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচন্দ্রর নির্দেশে নির্মান করা হয়। মন্দিরের তোরণটিও বেশ নজরক...